Fashion Gallery

আমিও শাড়ি

লাল শাড়ি ও কাচের চুড়ি পরে ছোট্ট মেয়েটিও বেরিয়ে পড়ুক বর্ষবরণে মা-বাবার হাত ধরে পয়লা বৈশাখে বর্ষবরণে বেরিয়ে পড়বে ছোট্ট মেয়েটি। তারও কি শাড়ি পরতে মন চাইবে না? এবার রইল ছোট্ট মেয়েদের শাড়ির খোঁজ।
‘পয়লা বৈশাখের দিন বড় আপু, মা সবাই লাল শাড়ি পরে। আমিও লাল শাড়ি পরে সেদিন মেলায় যাব। প্রতি বৈশাখে মা লাল রঙের শাড়ি-চুড়ি কিনে দেন।’ ঢাকার বসুন্ধরা শপিং কমপ্লেক্সে মায়ের সঙ্গে শাড়ি কিনতে এসে জানাল স্কুলপড়ুয়া নিয়তি।
বৈশাখের আয়োজনে ছোট্টমণিদের শাড়ি
‘বড়দের শাড়ি পরতে দেখে বাচ্চাদেরও মনে সাধ হয় শাড়ি পরার। অথচ ফ্যাশনের ক্ষেত্রে শিশুদের নিয়ে কম ভাবা হয়। তাই বৈশাখের আয়োজনে ছোট্ট মেয়েদের জন্য বৈচিত্র্যময় শাড়ির ডিজাইন করেছি। বৈশাখের ট্রেন্ড সাদা-লাল রং হলেও এবার বাচ্চাদের শাড়িতে সোনালি, কমলা, সবুজ—এসব রং দেখা যাবে।’ বলছিলেন ফ্যাশন হাউস কে ক্র্যাফটের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা শাহনাজ খান।
বাজার ঘুরে দেখা যায়, প্রচণ্ড গরমেও শাড়ি পরে শিশুরা যেন স্বস্তিবোধ করে। এদিকে লক্ষ রেখেই সুতির শাড়ি বিক্রি বেশি হচ্ছে। এ শাড়িগুলোতে ব্লকপ্রিন্ট, টাইডাই, বুটি, লেস, চুমকি, জরির কাজ করা হয়েছে। অনেক শাড়ির নকশায় উঠে এসেছে ঢোল, বাঁশি, হাতপাখা, একতারা—এসবের প্রতীক।
আবার কোনো কোনো ফ্যাশন হাউসে রেডি সেট শাড়ি বিক্রি করা হচ্ছে। ‘অনেক সময় দেখা যায় ছোট মেয়েরা শাড়ির কুঁচি সামলে রাখতে পারে না। তাই বাচ্চাদের শাড়ি পরতে উৎসাহী করতে রেডি শাড়ি ডিজাইন করা হয়েছে।’ বলছিলেন নগরদোলার প্রধান পরিচালন কর্মকর্তা মো. আলী আফজাল। এই শাড়িগুলোর কোমরে ইলাস্টিক দেওয়া। কুঁচি অনেকটা স্কার্টের মতো করে সেলাই করা আছে। পরা তাই খুব সহজ।

দরদাম
শাড়ির নকশার ওপর নির্ভর করে দাম নির্ধারণ করা হয়েছে। ঢাকার শাহবাগের আজিজ সুপার মার্কেটের ফ্যাশন হাউসগুলোয় বাচ্চাদের শাড়ি পাওয়া যাচ্ছে ৩৫০ থেকে ৬৫০ টাকায়। দেশীদশে পাবেন ৩৫০ থেকে এক হাজার ২০০ টাকায়। কে ক্র্যাফটে পাবেন জামদানি শাড়ি। দাম দুই হাজার টাকার মধ্যে। রেডি শাড়ি পাবেন নগরদোলায়। দাম ১০০০-১৭০০ টাকা। ফ্যাশন হাউস শৈশবে রেডি শাড়ির দাম পড়বে ৪৯০-১২৯০ টাকা। এ ছাড়া ঢাকার নিউমার্কেট, চাঁদনীচক ও মৌচাক মার্কেটেও পাবেন ছোট্টমণিদের শাড়ি।

কনে সাজে রাবীন্দ্রিক ঢং

বাঙালি নারীর শিক্ষা, সংস্কৃতি, ফ্যাশন সবকিছুর সঙ্গেই ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে কলকাতার জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়ি। এই বাড়িটিকে বাঙালি নারীর ফ্যাশনের সূতিকাগার বলাটা মোটেই বাড়াবাড়ি নয়। এই বাড়ির আধুনিকতা কেবল পোশাক-আশাক বা সাজসজ্জায় যে সীমাবদ্ধ ছিল তা কিন্তু না। বরং তাদের এই আধুনিকতার ছোঁয়া আমরা দেখতে পাই শিক্ষা এবং নারী জাগরণের ক্ষেত্রেও। বর্তমান সময়ে এসে যে কেউ-ই ঠাকুরবাড়ির সাজসজ্জার সঙ্গে এখনকার মেলবন্ধন ঘটিয়ে সাজে আনতে পারেন ঐতিহ্য এবং আধুনিকতার মিশেল। এ ক্ষেত্রে বাদ যাবে না কনের সাজও।
রবীন্দ্রসংগীতশিল্পী রেজওয়ানা চৌধুরী বন্যা মনে করেন, ঠাকুরবাড়ির মেয়েরা সেই সময়ে অন্দরমহল থেকে বের হয়ে আসতে শুরু করেছিলেন, মিশতে শুরু করেছিলেন বাইরের দুনিয়ার সঙ্গে। তাই তাঁদের যাত্রার সবকিছুতেই আধুনিকতার ছোঁয়া লেগেছিল। এ কারণেই আমরা তাঁদের শাড়ি পরার স্টাইলের মধ্যেও খুঁজে পাই প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের মেলবন্ধন। আমরা জানতে পারলাম, ঠাকুরবাড়ির একটি ঐতিহ্য ছিল বিয়ের সময় বর একটি কালো বেনারসি শাল গায়ে চাপিয়ে তবেই বিয়ে করতেন, যা স্বয়ং রবীন্দ্রনাথও করেছিলেন। কালো রংকে সব সময় বিয়ের আয়োজন থেকে শত হাত দূরে রাখলেও ঠাকুরবাড়িতে ঘটেছিল ঠিক উল্টোটিই। আর এভাবেই ঠাকুরবাড়ির ঐতিহ্য আর আধুনিকতা এখন পর্যন্ত মিলেমিশে চলে আসছে আমাদের সমাজেও।
ফ্যাশন হাউস শতাব্দীর ডিজাইনার নাদিরা আযাদ মনে করেন, ঠাকুরবাড়ির মেয়েরা সে সময় বিয়ের সাজে পরতেন একহারা ঢঙে শাড়ি। কখনো সেই শাড়ি কোমরে স্কার্ট বা লেহেঙ্গার মতো গুঁজে দিয়ে অনেকটা বিলেতি কেতায় পরা হতো। আবার সেসব শাড়ির আঁচলে দেখা যেত অনেক ভাঁজ। এই ভাঁজগুলো কাঁধের কাছে আটকে রাখা হতো ব্রোচ কাঁটা দিয়ে; শাড়ি পরার কেতা তো রয়েছেই। চিত্রা দেবের লেখা ঠাকুরবাড়ির অন্দরমহল বইটিতে আমরা বিয়ের যে ছবিগুলো দেখি, তার সব কটিই মূলত মসলিন, বেনারসি বা ঢাকাই শাড়িপরা কনের ছবি। এ থেকে আমরা বুঝতে পারি, ঠাকুরবাড়িতে বুনন-বৈচিত্র্যসমৃদ্ধ শাড়ির চলই বেশি ছিল। আর সেই ঐতিহ্য মাথায় রেখে আমরা এখনকার বিয়েতে ব্যবহার করতে পারি জামদানি শাড়ি। লাল, সোনালি, কোড়া রঙের জামদানি শাড়িতে জরির কাজ আর তার সঙ্গে মানানসই ওড়না বিয়েতে অনায়াসে আনতে পারে ঠাকুরবাড়ির বউদের সাজসজ্জার ছোঁয়া। ব্লাউজগুলো একটু লম্বা হাত দিয়ে বানিয়ে তাতে লেইসের ব্যবহারে আসবে রাবীন্দ্রিক ঢং। আবার জামদানির বাইরে গিয়ে কনেরা মসলিনের শাড়ি পরেও আনতে পারবেন একই ধরনের লুক।
নাদিরা আযাদের মতের সঙ্গে একমত কে ক্র্যাফটের প্রধান নির্বাহী শাহনাজ খানও। তিনি বলেন, ‘ঠাকুরবাড়ির বিয়ের সাজগুলো যদি আমরা একটু ভালোভাবে লক্ষ করি, তাহলে দেখতে পাব, তাঁদের বিয়ের সাজসজ্জায় আভিজাত্যের পাশাপাশি রুচির ছাপও পাওয়া যায়। সেই সময়ে তাঁদের মধ্যে সাজসজ্জার যে চল ছিল, তা আমরা এখনো নিয়ে আসতে পারি আমাদেরই বুনন-বৈচিত্র্যে সমৃদ্ধ শাড়িগুলোর মাধ্যমে। এই ফ্যাশনে যেমন রুচির পরিচয় দেওয়া যায়; তেমনি বিয়ে আয়োজনের আড়ম্বরে নিজের আরামকেও প্রাধান্য দেওয়া সম্ভব।’ তাই শাহনাজ খানের পরামর্শ, রাবীন্দ্রিক ঢঙে সাজতে চাইলে মসলিন, জামদানি বা টুইল (রাজশাহী সিল্কের বুনন ধাঁচে টাঙ্গাইলে তৈরি সিল্ক) শাড়ি বেছে নেওয়া যেতে পারে। এগুলোতে থাকতে পারে কাতানের প্যাচওয়ার্ক, কারচুপি বা লেইসের ব্যবহার। তবে ব্লাউজে রাবীন্দ্রিক ঢঙের ক্ষেত্রে চিকন লেইস এবং পাইপিংয়ের ব্যবহার করাটাই ভালো। বেশি চওড়া লেইস আবার কনের শাড়ির সঙ্গে মানানসই হবে না।
গয়নার ক্ষেত্রে অনেক বেশি প্রাধান্য ছিল সোনার পেটানো গয়নার। গলায় কয়েক লহরের চেইন, সীতাহার, চোকার এবং কানে ঝুমকার চেয়ে বেশি চোখে পড়ত কানজুড়ে থাকা দুল বা লম্বাটে নকশার কোনো দুল। সোনা ছাড়া গয়নার নকশায় মুক্তোর ব্যবহারও দেখা গেছে। হাতভর্তি কয়েক গাছি সোনার চুড়ি, সেই সঙ্গে গোলাপবালাও। বাহুতে বাজুবন্ধের ব্যবহারও ছিল লক্ষণীয়। সে সময়ে অনেক বেশি গয়নার ব্যবহার দেখা যেত চুলের সাজে। এই বিষয়ে নাদিরা আযাদের মতামত হলো, বেণি করে সেই বেণি পেঁচিয়ে খোঁপায় বেঁধে ছোট ছোট সোনালি কাঁটায় খোঁপা সাজানো যেতে পারে। সেই সময়ে টিকলির পাশাপাশি দুই পাশে গোল একধরনের গয়না লাগানো হতো। সেগুলোও ব্যবহার করা সম্ভব। কনে সাজের বিষয়ে চিত্রা দেব তাঁর ঠাকুরবাড়ির অন্দরমহলে লিখেছেন ‘সোনালি ফিতে লাগিয়ে খোঁপায় সোনার কাঁটা ও চিরুনি, কপালে ও গালে চন্দনের পত্রলেখা। লাল টুকটুকে বেনারসির সঙ্গে টিকলি, দুল, নথ, বাজুবন্ধ, শাঁখা, চুড়ি, বালা, আলতা পরা পায়ে রুনুঝুনু মল, হাতে লাল লক্ষ্মীকাঠের চুড়ি। এ যেন সাক্ষাৎ লক্ষ্মী ঠাকরুন।’
রূপবিশেষজ্ঞ কানিজ আলমাস খান বলেন, একটা সময় কনেকে অনেক বেশি মেকআপ দেওয়া হতো। কিন্তু কয়েক বছর ধরেই এই সাজে এসেছে ভিন্নতা। এখনকার কনেরা মেকআপ পছন্দ করে, তবে তাতে থাকতে হবে সাধারণত্ব। চুলের বাঁধন কিংবা মেকআপ যা-ই হোক, তাতে চাই পুরোনো ঢঙের ছোঁয়া। আর এ ক্ষেত্রে অবশ্যই ঠাকুরবাড়ির সাজসজ্জাই লক্ষণীয়। উঁচু করে চুড়োয় খোঁপা বা বেণি খোঁপা, সামনে ঢেউখেলানো চুলের বাঁধন—সবই যেন ঠাকুরবাড়ির কনের সাজসজ্জা মনে করিয়ে দেয়। এই সাজের সার্থকতা তখনই পাওয়া যায়, যখন মসলিনের দোপাট্টার ফাঁকে চেলি করা খোঁপায় দেখা যায় আভিজাত্যের ছোঁয়া।
এভাবেই হয়তো ঠাকুরবাড়ির বাঙালির সব উৎসব-পার্বণে মিলেমিশে রয়েছে ঐতিহ্য আর আধুনিকতা।

Leave a comment